Law Lab
Law Lab
Story

মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের দায়িত্ব কার? ডাক্তার না পুলিশ?

11 November 2021

১। পহেলা জানুয়ারী ২০১৭ তারিখে সুনামগঞ্জ জেলার কার্তিকপুর গ্রামে অনুমান দুপুর ১২ ঘটিকায় একটি মারামারি অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে দন্ডবিধির ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩২৪/৩২৬/৩৫৪/৫০৬ ও ১১৪ ধারায় একটি মামলা রজু হয়। উক্ত ঘটনায় বাদীনির পিতা মোঃ V (৬৫) গুরুতর আহত হয়। ওসমানী মেডিকেল কলেজে তার চিকিৎসা হয়। তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। ঘটনার ১৭ দিন পর V মৃত্যু বরণ করেন। যথারীতি সকল আসামীদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০২ ধারা যোগ হয়। ২৩ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে তদন্তকারী কর্মকর্তা দন্ডবিধির ধারা ৪৪৭/৩২৩/৩৫৪/৫০৬ ও ১১৪ ধারার প্রথম অভিযোগ পত্র দায়ের করেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, তার স্বাভাবিক মৃত্যু (Natural death) হয়েছে। এই ঘটনায় বাদীনি নারাজি পিটিশন দায়ের করলে অধিকতর তদন্ত হয়। উক্ত তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা দন্ডবিধির ৩০২ ও ৩০৭ ধারা যোগ করে অভিযোগ পত্র দায়ের করেন। এরই ভিত্তিতে ২২ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে দায়রা জজ আদালত সুনামগঞ্জ সকল আসামীর বিরুদ্ধে ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩০২ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করেন। দায়রা জজের অভিযোগ গঠন আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আমরা রিভিশন মোকদ্দমা দায়ের করি।

২। অভিযোগকারী ০৬ জানুয়ারী ২০১৭ তারিখে ৭ জনকে বিবাদী করে সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই থানায় অত্র মোকদ্দমা দায়ের করেন। তার অভিযোগের সংশ্লিষ্ট অংশ তুলে ধরা হলঃ

“আমার পিতা ১ নং সাক্ষী জনাব V গ্রামের গণ্যমান্য লোকজনকে জানাইলে সকল বিবাদীগণ আমার পিতার প্রতি আক্রোশান্বিত হইয়া পূর্বাক্রোশে একদলভূক্ত হয়ে পূর্ব পরিকল্পনা মতে একই উদ্দেশ্য সাধন কল্পে হাতে দা, রাম দা, কুদাল, লাঠিসোটা ইত্যাদি দেশীয় প্রাণনাশক অস্ত্রসত্র নিয়া বর্ণিত ঘটনার তারিখ ও সময়ে নিম্ন তফসিল বর্ণিত বুরো জমিতে আসিয়া আমার বৃদ্ধ পিতা এক নং সাক্ষী V কে প্রাণে মারার জন্য আক্রমণ করতঃ বিবাদী Y এর হুকুমে বিবাদী Z এর কোদালের হাতল দিয়া প্রাণে মারার উদ্দেশ্যে এক নং সাক্ষীর মাথার মধ্যস্থানে বাড়ি মারিয়া মারাত্মক রক্তাক্ত জখম করে। সাথে সাথে বিবাদী X মিয়া তার হাতে থাকা রামদা দিয়া প্রাণে মারার উদ্দেশ্যে এক নং সাক্ষীর মাথার বাম পাশে ছেদ মারিয়া রক্তাক্ত জখম করে। বিবাদী X তার হাতে থাকা দা দিয়া প্রাণে মারার উদ্দেশ্যে এক নং সাক্ষীর মাথার ডান পাশে ছেদ মারিয়া কাটা রক্তাক্ত জখম করে…।”

৩। উক্ত ঘটনায় ভিকটিম V কে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। ০৮ জানুয়ারী ২০১৭ তারিখে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ চিকিৎসা শেষে তাকে ডিসচার্চ সার্টিফিকেট দেয়। ১৯ জানুয়ারী ২০১৭ তারিখে ৭.৩০ মিনিটি তিনি নিজ বাড়িতে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যু পরবর্তী মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের জন্য ময়না তদন্তের জন্য প্রেরণ করা হয়। ময়না তদন্ত রিপোর্টে মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ খুজে না পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক কোন অভিমত প্রদান করেন নাই। বরং মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের লক্ষ্যে viscera রিপোর্ট এর জন্য The Chemical Examiner to the Government of Bangladesh Forensic Laboratory, Bangladesh Police, C.I.D. Chittagong এ প্রেরণ করা হয়। ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে Chemical Analysis রিপোর্ট এ নিম্নোক্ত মতামত প্রদান করেঃ

“As the chemical analysis report of viscera shows no poison and as the histopathological report of heart shows normal findings and injuries noted in PMR were not sufficient to cause death. Hence no unnatural cause of death could be detected during autopsy.”

৪। উক্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা ৭ জন আসামীর বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩৫৪/৫০৬ ও ১১৪ ধারায় অভিযোগ পত্র দায়ের করেন। নিম্নে প্রয়োজনীয় অংশ তুলে ধরা হলঃ

“ময়না তদন্ত করার সময় যে সমস্ত আঘাত পাওয়া গিয়াছে তাহা উক্ত মৃত ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নহে। সুতরাং অস্বাভাবিক মৃত্যুর কোন কারণ ময়না তদন্তের সময় পাওয়া যায় নাই।”

কিন্তু ২য় তদন্তকারী কর্মকর্তা রুক্কুন উদ্দিন, পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র), বিপি নং- ৭০৮৯০১০২৭৭ জেলা গোয়েন্দা শাখা, সুনামগঞ্জ সকলের বিরুদ্ধে ৩০২ ও ৩০৭ ধারা যোগ করে অভিযোগ পত্র দায়ের করেন। সংশ্লিষ্ট অংশ তুলে ধরা হলঃ

“মৃত V এর ময়না তদন্ত রিপোর্ট ও ভিসেরা রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায় ডাক্তার সাহেবগণ V এর মৃত্যু সংক্রান্তে মতামত দেন রাসায়নিক রিপোর্ট-এ কোন বিষ পাওয়া যায়নি। হিস্ট্রোপ্যাথলজিক্যাল পরীক্ষায় (হৃদপিন্ড)রিপোর্ট স্বাভাবিক ময়না তদন্ত করার সময় যে সমস্ত আঘাত পাওয়া গিয়াছে তাহা উক্ত ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নহে। সুতরাং অস্বাভাবিক মৃত্যুর কোন কারণ ময়না তদন্তের সময় পাওয়া যায় নাই বলিয়া রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু আমার তদন্তকালে ও প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রামাণে জানা যায় বিবাদীদের মারপিটের কারণে V জখমী অবস্থায় প্রথমে দিরাই পরে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে জখমের চিকিৎসা গ্রহণ করেন। কিছুটা সুস্থবোধ হইলে হাসপাতাল হইতে বাড়িতে আসিয়া ঔষধ পত্র সেবন করতে থাকেন। কিন্তু বিবাদীদের আঘাতে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা ও যন্ত্রণা ভোগ প্রতিদিনই চিৎকার করিতেন। কেউ কোন কিছু জিজ্ঞাসা করিলে কথা বলিতে পারিতেন না। শুধু ইশারা দিয়া মাথায় যন্ত্রণা হইতেছে বোঝানোর চেষ্টা করিতেন। এই যন্ত্রণায় ও দিনে দিনে অসুস্থ হওয়ার কারণে V মৃত্যু বরণ করিয়াছেন বলিয়া তদন্তে প্রতিয়মান হয়।”

৫। ২৪ জুন ২০১৮ তারিখে দায়রা জজ আদালত সুনামগঞ্জ এ মামলাটি স্থানান্তর হয়। ২২ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে উভয় পক্ষকে শুনানিয়ন্তে সকল আসামীর বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩০২ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করে। উক্ত আদেশের প্রয়োজনীয় অংশ নিম্নে তুলে ধরা হলঃ

“রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপিত পর্যালোচনায় ইহা সুস্পষ্ট যে,…এর বিরুদ্ধে দ্যা পেনাল কোডের ১৪৩/৪৪৭/৩৩২/৩০২/৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠনের উপাদান রয়েছে ফলে আসামীগণের দাখিলি অব্যাহতির দরখাস্ত নামঞ্জুর করা হল। আসামীগণের বিরুদ্ধে দ্যা পেনাল কোডের ১৪৩/৪৪৭/৩৩২/৩০২/৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হল। গঠিত অভিযোগ আসামীগণকে পাঠ ও ব্যাখ্যা করে শুনানো হলে আসামীরা নিজেদেরকে নির্দোষ দাবি করে বিচার প্রার্থনা করেন।”

৬। ৩০ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে দায়রা আদালতের অভিযোগ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে অত্র রিভিশন মোকদ্দমা দায়ের করি। আদালতের বিভিন্ন অসুবিধা থাকার কারণে মামলাটি শুনানি করতে একটু বিলম্ব হয়। অত্র মামলা সর্বমোট ৪ দিন শুনানি হয়। যেহেতু বিষয়টি একটু ব্যতিক্রম সেহেতু আমার চেম্বারের সকলকে নিয়ে আমি লিগ্যাল রিসার্চ সম্পন্ন করি। The Code of Criminal Procedure, The Police Regulation of Bengal, 18 BLC (AD) 218, 29 BLD (AD) 66, 25 BLD (AD) 185, 17 BLD (AD) 54 ও 17 BLD 01 মামলাসমূহ এবং ভারতী এখতিয়ারের (AIR 2019 SC 5721, (2011) 4 SCC 249, (2010) 1 SCC 153, (1994) Supp (2) SCC 289, AIR 1994 SC 1539, (1992) 4 SCC 69, (1987) 1 SCC 679, (1983) 1 SCC 379, 2010 (2) GLD 595 (GAW) (2006) 3 CALLT 288 (HC) এবং (1996) 6 SCC 129 নজিরসমূহ উপস্থাপন করি। সকল আইন ‍ও মামলার সিদ্ধান্ত সমূহ সমন্বয়ে ১৩৯ পাতার একটি বই আদালতে দায়ের করি। আদালত অত্যন্ত ধৈর্যের সহিত ৪ দিন শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আসার জন্য নির্দেশনা দেন। রাষ্ট্রপক্ষ আমার উপস্থাপিত এই সকল নজিরের কোন জবাব না দিয়ে আবেগময় বক্তব্য উপস্থাপন করেন। শুনানিঅন্তে আদালত পরবর্তী সপ্তাহে আদেশের জন্য দিন ধার্য করেন। সিনিয়র বিচারপতি আমার পক্ষে আদেশ দিতে রাজি হলেও জুনিয়র বিচারপতি রাজি হননি। অবশেষে সিনিয়র বিচারপতি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন “শিশির মনির, আপনি অনেক কষ্ট করেছেন। খাটাখাটি করেছেন। আমরা উপকৃত হয়েছি। আমাদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আমরা আপনার পক্ষে আদেশ দিতে পারছিনা। আপনি চাইলে আমরা Summarily Reject করে পূর্ণাঙ্গ রায় দিতে পারি। আপনি এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন। এখন আপনি কি করতে চান? আপনি কি রায় নিবেন নাকি নট প্রেস করবেন?” আমি কিছুক্ষণ নিরব দাড়িয়ে থাকি। কোর্টে শুনশান নিরবতা। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, মাই লর্ড আমি নট প্রেস করব তবে আমার একটু শেষ কথা আছে। সিনিয়র জজ সাহেব একটু বিচলিত হয়ে বললেন ‘বলেন, বলেন’। আমি বললাম “My Lords, I tried my best. Me along with my eight juniors passed sleepless night. We conducted extensive legal research. We perused our jurisdiction and Indian jurisdiction. We submitted plethora of decisions but finally failed to convince my lords. A question tickles in my mind who is the appropriate person to certify the cause of death? Is it the Doctor or the Investigating Officer? I wanted to settle this point. However, for the time being I could not. Next time, I hope I would be able to apply these decisions in another appropriate case.”

সিনিয়র বিচারপতি বললেন, “মিঃ মনির, this is the beauty of this profession. You tried your best but we did not agree with you. This is how this profession flourishes and the lawyers are called as learned.”